পদ্মা সেতু শুধু একটি সেতুই নয়, এটি বাংলাদেশের প্রকৌশল সক্ষমতার এক মহা নিদর্শন। সেতুটি একটি মাল্টি-স্প্যান স্টিল ট্রাস সেতু, দৈর্ঘ্য প্রায় ৬.১৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ১৮.১০ মিটার। এর উপরের স্তরে রয়েছে চার লেনের সড়কপথ আর নিচের স্তরে ডুয়েল গেজ রেললাইন। এটি বিশ্বের গভীরতম নদীতে পাইল বসানোর রেকর্ড গড়েছে—পদ্মার তলদেশে ১২২ মিটার গভীর পর্যন্ত পাইল বসানো হয়েছে। বিশাল স্রোত, অস্থির চর ও নদীর ভাঙন সত্ত্বেও সেতুটি দাঁড় করানো প্রকৌশলীদের এক বিরল অর্জন।
পদ্মা নদী বিশ্বের সবচেয়ে প্রখর স্রোতধারার নদীগুলির মধ্যে একটি। এখানে কাজ করা মানেই ছিল প্রকৌশলীদের জন্য এক যুদ্ধ। নদীর তলদেশের অস্থির চর, প্রবল স্রোত, ভাঙন, আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়মিতই বাধা হয়ে দাঁড়াত। ভিয়াডাক্ট, পাইলিং, স্প্যান বসানো—সব ধাপেই ছিল চরম ঝুঁকি। শীতকালে পানি নেমে যাওয়ায় কাজ করা যেত, কিন্তু বর্ষা এলেই নদী যেন তার ভয়ংকর রূপ দেখাত। তাছাড়া, প্রাথমিক পর্যায়ে প্রকল্প থেকে বিদেশি ঠিকাদার সরে যাওয়া এবং অর্থায়ন বাতিল হয়ে যাওয়ায় প্রকল্পটি আরও জটিল হয়ে ওঠে।
২০০৭ সালে বিস্তারিত নকশা তৈরির পর প্রাথমিকভাবে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাইকা এবং আইডিবি অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু ২০১১ সালে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক ঋণ বাতিল করে। এতে প্রকল্পটি কার্যত থমকে যায়।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেন- বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণ করবে। এর মাধ্যমে তিনি জাতিকে নতুন আত্মবিশ্বাস দিয়েছিলেন। প্রায় ৩০,০০০ কোটি টাকার বেশি খরচে পুরো সেতু দাঁড়িয়ে গেছে শুধু বাংলাদেশের জনগণের অর্থে, যা এক অনন্য নজির।
পদ্মা সেতুর ইতিহাস বলতে গেলে শেখ হাসিনার নাম প্রথমেই আসবে। বিশ্বব্যাংকের মতো শক্তিশালী দাতা সংস্থা যখন ঋণ বাতিল করে, তখন তিনি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। তার দৃঢ় সিদ্ধান্ত, রাজনৈতিক সাহস আর জাতিকে বিশ্বাস করানোর ক্ষমতার ফলেই প্রকল্প এগিয়ে চলে। শেখ হাসিনা শুধু অর্থায়নের বিকল্প তৈরি করেননি, বরং প্রকৌশলীদের অনুপ্রাণিত করে প্রকল্পে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেন। তার নেতৃত্বে এই সেতু আজ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্যের প্রতীক।
পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর বাংলাদেশ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করেছে। ঢাকা থেকে যশোর, খুলনা, বরিশালসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দূরত্ব কমেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। শিল্প, কৃষি ও বাণিজ্যে এসেছে গতি। যোগাযোগ সহজ হওয়ায় গ্রামীণ অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে, শিক্ষার্থী ও রোগীরা দ্রুত ঢাকায় পৌঁছাতে পারছে। সেতুটি ভবিষ্যতে ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখবে। পদ্মার দুই পারের পর্যটন শিল্পেও এসেছে নতুন সম্ভাবনা।
পদ্মা সেতু শুধু একটি অবকাঠামো নয়, এটি বাংলাদেশের আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। প্রকৌশল বিস্ময়, অর্থায়নের সাহসী সিদ্ধান্ত এবং শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে এটি বাস্তবে রূপ পেয়েছে। আজ পদ্মা সেতু দাঁড়িয়ে আছে প্রমাণ হিসেবে—বাংলাদেশ পারে, যদি সে নিজেকে বিশ্বাস করে।